কৌশল সফল, ভয়টা থাকলই (AAP wins Delhi elections but the fear of Hindutwa still prevails)
Published @ Anandabazar Patrika
To view the published version, see
Anandabazar Patrika

রাজধানীতে ভোট ঘোষণার পর জানলাম, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সূত্রে নির্বাচনে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে—একজ়িকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা।
এই কাজের সূত্রে রাজনীতি নামক বস্তুটির একটা ‘রিংসাইড ভিউ’ পাওয়ার সুযোগ হল। নির্বাচনের কাজে বেরিয়ে তাই দেখার কৌতূহল হল যে আপ-এর মতো একটা আঞ্চলিক ছোট দল কী ভাবে বিপুল ধনী এবং সর্বশক্তিমান একটি সাম্প্রদায়িক মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। অরবিন্দ কেজরীবালের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তো ছিলই, সঙ্গে ছিল গত পাঁচ বছরের কাজের খতিয়ান। দিল্লিতে যাঁরা বসবাস করেন তাঁরা একমত হবেনই, আপ শুধু যে বেশ কিছু সুসংহত কাজ করেছে তা-ই নয়, সেই কাজের প্রভাব মানুষের কাছে বার বার তুলে ধরতেও দ্বিধা করেনি। অর্থাৎ কাজ আর ওই কাজের বিজ্ঞাপন সমান্তরাল ভাবে করা হয়েছে।
পূর্ণ রাজ্যের তুলনায় দিল্লির সরকারের ক্ষমতা সীমিত। তাই কাজ করার বা প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রও সীমিত। কিন্তু তাও বিদ্যুৎ, জল, ইস্কুল, হাসপাতাল, মহল্লা চিকিৎসালয়, মেট্রোর চোখধাঁধানো বিস্তার, মহিলাদের বিনামূল্যে বাসে যাতায়াত ইত্যাদি মিলিয়ে আপ দিল্লির জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশকে কোনও না কোনও ভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে। ফল বেরোনোর পর এটা খুব পরিষ্কার যে মানুষ এই ‘কাজের রাজনীতি’কেই সমর্থন করেছেন, কিন্তু নির্বাচনের প্রচারের সময় এই কথা বারবার শুনেছি, এই রিপোর্ট-কার্ড নির্বাচন জেতার জন্য যথেষ্ট কি না, সেই নিয়ে আপ নেতৃত্বের কিছুটা হলেও সন্দেহ ছিল।
এর কারণ যতটা না তাঁদের কাজের ফলাফল নিয়ে, তার থেকে অনেক বেশি ভারতের রাজনীতির অদ্ভুত সমস্ত সমীকরণ নিয়ে। যে নির্বাচনী কেন্দ্র আমার দায়িত্বে ছিল— কালকাজি— সেখানে যেমন শুরু থেকেই একটা দ্বন্দ্ব লক্ষ করেছিলাম। কালকাজির মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত জনসংখ্যার একটা বড় অংশ শিখ ধর্মাবলম্বী। এই অঞ্চলে একাধিক গুরুদ্বার আছে এবং তাকে ঘিরে বিভিন্ন পর্যায়ের এবং বিভিন্ন ক্ষমতার সংগঠন আছে। এই অঞ্চলের ভোটের ফলাফল তাই অনেকাংশেই নির্ধারিত হয় এই সংগঠনগুলি দ্বারা। বহু বছর কংগ্রেস থাকার পরে ১৯৮৪-র পর এই ধরনের পাড়াগুলিতে কংগ্রেসের সমর্থন হুহু করে কমতে থাকে এবং অচিরেই অকালি হয়ে বিজেপির দিকে যায়। ২০১৩ পরবর্তী সময়ে আপ এই সমর্থনে থাবা বসায়— অঞ্চলের শিখ নেতৃত্বই ছিল আপ-এর সম্বল। সে রকমই এক জন এ বারও আপ-এর সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু সেখানে আপ প্রার্থী করল অতিশীকে (ছবিতে)। দিল্লির অ-বিজেপি সমর্থকদের মধ্যে অতিশীর জনপ্রিয়তা লক্ষ করার মতো, বিশেষ করে সরকারি স্কুলশিক্ষার খোলনলচে বদলে ফেলার প্রধান রূপকার হিসেবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কালকাজির আনাচকানাচে শুনেছি, অঞ্চলের শিখ নেতৃত্ব এই প্রার্থী নির্বাচন ভাল ভাবে নেননি, কারণ অতিশী যথেষ্ট আঞ্চলিক নন, শিখ তো ননই। সেই নিয়ে আপ নেতৃত্বের চিন্তা ছিল। তাই আপ বিস্তারিত প্রচার করার দিকে মন দেয়।
এই প্রচারের দুটো দিক ছিল। এক, অঞ্চলের সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছনো। গত এক মাস বার বার দেখেছি, আপ এই কেন্দ্রের যে বিস্তীর্ণ বস্তি অঞ্চল বা এখানকার ভাষায় জাগ্গি-ঝুপড়ি ক্লাস্টার, নবজীবন ক্যাম্প, ট্রানজ়িট ক্যাম্প, নেহরু ক্যাম্প, শ্রীনিবাসপুরীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রচার চালিয়েছে। সাদা নীল টুপি, পতাকা, ব্যানার চোখে পড়েছে নিরন্তর। অর্থাৎ কাজের দাম অঞ্চলের মানুষ এমনিই দেবেন, এ কথাটা ভেবে নিয়ে আপ চুপচাপ বসে থাকেনি। আপ-এর প্রচারে, মিছিলে, পথসভায় বা নির্বাচনের দিন পার্টির টেবিলে, বুদ্ধিমান ঝকঝকে ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি। আপ যে তরুণদের বাইরে থেকে আলতো সমর্থন করার প্রবণতা থেকে তাদের পার্টির অন্দরে আনতে পেরেছে, সেটা অনস্বীকার্য। তার ফল যে পাওয়া গিয়েছে, আসনের সংখ্যাই তার প্রমাণ। গত বারের ৬৭ আসন ছিল প্রায় মিরাক্ল। কিন্তু এ বারে বিজেপির বহুমুখী আক্রমণের সামনে ৬২, তাকেও ছাপিয়ে যায় সন্দেহ নেই।
আপ-এর দ্বিতীয় কৌশল ছিল বর্ণহিন্দু ভোট অখুশি হতে পারে, এই রকম কোনও প্ররোচনায় পা না দেওয়া। বিজেপি বারবারই আপকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছে, কেজরীবাল বারবার সেটা এড়িয়ে গিয়েছেন। শাহিন বাগের পক্ষে কথা বললে হিন্দু ভোটে ধস নামার আশঙ্কা ছিল। সন্দেহ নেই, এই কৌশল আপ-এর পক্ষেই গিয়েছে। জানুয়ারির ১৯ তারিখ দিল্লিকে জাতীয় সিকিয়োরিটি অ্যাক্ট (এনএসএ)-এর অধীনে নিয়ে আসা হল। সামান্য ছুতোয় আপ-এর প্রথম সারির নেতাদের এই আইনে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেওয়া অসম্ভব ছিল না।
আপ-এর জয়ে জাতীয় স্তরে ঘৃণার রাজনীতি আটকাবে, সে ভরসা নেই। কেজরীবালের নরম হিন্দুত্ব প্রমাণ করে, বিচ্ছিরি ভাবে হেরেও পুরোটা হারেনি হিন্দুত্ব। ভয়টা সেখানেই।
comments for this post are closed