যে খেলোয়াড় আর তাঁর জনপ্রিয়তা — এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস (Maradona – Icon of the global south)
Published @ Anandabazar Patrika
To view the published version, see
Anandabazar Patrika

সালটা ১৯৭৬। বেঁটেখাটো শক্তসমর্থ একটি ছেলে। ১৬ বছর বয়স হওয়ার দশ দিন আগে ১৬ নম্বর জার্সি গায়ে এই ক্লাবে খেলার সুযোগ হয়েছে তার সম্প্রতি। আর্জেন্টিনোস। প্রিমেরা ডিভিশন। বুয়েনোস আইরেস। ক্লাবের ইতিহাসে কনিষ্ঠ খেলোয়াড়। জন্ম আর বেড়ে ওঠা ভিল্লা ফিয়োরিতো বারিয়ো নামে বুয়েনোস আইরেস-এর দরিদ্রতম অঞ্চলের একটিতে। অথচ ফুটবলের ভাষা তখনই এই ছোকরার নখদর্পণে। আরও একটা জিনিসের জন্য সে বিখ্যাত। নাটমেগ। অর্থাৎ, বলটাকে অন্য খেলোয়াড়ের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে বার করে তাকে বোকা বানানো। সে যে কেবল দু’বছরে ক্লাবের প্রধান ভরসা হয়ে উঠল তা নয়, মুখে মুখে ফিরতে লাগল যে সে এখন আর্জেন্টিনারও ভবিষ্যৎ। কিন্তু এই সময়ে বিশ্বকাপ দল থেকে হঠাৎ বাদ রাখা হল তাকে, ‘কচি’ বলে। আর এই সময়েই একটা হালকা বিরোধ বাধল দেশের প্রথিতযশা আর্জেন্টিনোস ক্লাবে। খেলোয়াড়েরা জানাল, ম্যাচ জেতার বোনাস চাই। কারণ সেই দিয়ে তারা সদ্য-আগত রঙিন টেলিভিশন কিনতে চায়। তাদের দাবি তুলে ধরতে এগিয়ে এল নাটমেগ-খ্যাত সহকর্মী। ক্লাব সভাপতিকে জানিয়ে দিল, বোনাস-এর টাকা না পেলে তারা আর খেলবে না। সাহস দেখানোর সেই শুরু।
দশ বছর পর। কলকাতা। তখন টিভি যদিও বা থাকে মানুষের বাড়িতে, তাও সাদাকালো। সামনেই ফুটবল বিশ্বকাপ। সরাসরি খেলা দেখা যাবে শুরুর দিন থেকে। ১৯৮২ তো ছিল ‘কার্টেন-রেজ়র’। ঘরে ঘরে বাচ্চারা জানাল, অন্তত একটা সাদাকালো টিভি না পেলে তারা পড়াশোনা করবে না। কারণ? আবার সেই একই নাটমেগ-খ্যাত লোক। ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। তুখোড়, সাহসী, সদা-চঞ্চল এবং যাকে আটকাতে হিমশিম খায় বিরোধীপক্ষ। আর্জেন্টিনোস থেকে বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা হয়ে যে তখন নাপোলি কাঁপাচ্ছে। ১৯৭৯-তে আঠারো বছর সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই সে আর্জেন্টিনাকে পাইয়েছে ফিফা জুনিয়র বিশ্বকাপ। তুমুল গোলযোগের মধ্যেও বার্সেলোনাকে পাইয়ে দিয়েছে কোপা ডেল রে, স্প্যানিশ সুপার কাপ। ১৯৮৩-র এল ক্লাসিকোর সময়ে হেরে গিয়েও যার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে ওভেশন জানায় বার্সেলোনার আর্চ-রাইভাল রিয়েল মাদ্রিদ-এর সমর্থকেরা। যে একাই পারে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতাতে। তাকে দেখতে টিভি চাই। কারণ শুধু ধারাবিবরণী দিয়ে, শুধু বর্ণনা দিয়ে, তাকে বোঝানো যায় না। সেই ভাষা ফুটবলের তখনও তৈরি হয়নি। কারণ তিনি দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।
সালটা ১৯৭৬। বেঁটেখাটো শক্তসমর্থ একটি ছেলে। ১৬ বছর বয়স হওয়ার দশ দিন আগে ১৬ নম্বর জার্সি গায়ে এই ক্লাবে খেলার সুযোগ হয়েছে তার সম্প্রতি। আর্জেন্টিনোস। প্রিমেরা ডিভিশন। বুয়েনোস আইরেস। ক্লাবের ইতিহাসে কনিষ্ঠ খেলোয়াড়। জন্ম আর বেড়ে ওঠা ভিল্লা ফিয়োরিতো বারিয়ো নামে বুয়েনোস আইরেস-এর দরিদ্রতম অঞ্চলের একটিতে। অথচ ফুটবলের ভাষা তখনই এই ছোকরার নখদর্পণে। আরও একটা জিনিসের জন্য সে বিখ্যাত। নাটমেগ। অর্থাৎ, বলটাকে অন্য খেলোয়াড়ের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে বার করে তাকে বোকা বানানো। সে যে কেবল দু’বছরে ক্লাবের প্রধান ভরসা হয়ে উঠল তা নয়, মুখে মুখে ফিরতে লাগল যে সে এখন আর্জেন্টিনারও ভবিষ্যৎ। কিন্তু এই সময়ে বিশ্বকাপ দল থেকে হঠাৎ বাদ রাখা হল তাকে, ‘কচি’ বলে। আর এই সময়েই একটা হালকা বিরোধ বাধল দেশের প্রথিতযশা আর্জেন্টিনোস ক্লাবে। খেলোয়াড়েরা জানাল, ম্যাচ জেতার বোনাস চাই। কারণ সেই দিয়ে তারা সদ্য-আগত রঙিন টেলিভিশন কিনতে চায়। তাদের দাবি তুলে ধরতে এগিয়ে এল নাটমেগ-খ্যাত সহকর্মী। ক্লাব সভাপতিকে জানিয়ে দিল, বোনাস-এর টাকা না পেলে তারা আর খেলবে না। সাহস দেখানোর সেই শুরু।
দশ বছর পর। কলকাতা। তখন টিভি যদিও বা থাকে মানুষের বাড়িতে, তাও সাদাকালো। সামনেই ফুটবল বিশ্বকাপ। সরাসরি খেলা দেখা যাবে শুরুর দিন থেকে। ১৯৮২ তো ছিল ‘কার্টেন-রেজ়র’। ঘরে ঘরে বাচ্চারা জানাল, অন্তত একটা সাদাকালো টিভি না পেলে তারা পড়াশোনা করবে না। কারণ? আবার সেই একই নাটমেগ-খ্যাত লোক। ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। তুখোড়, সাহসী, সদা-চঞ্চল এবং যাকে আটকাতে হিমশিম খায় বিরোধীপক্ষ। আর্জেন্টিনোস থেকে বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা হয়ে যে তখন নাপোলি কাঁপাচ্ছে। ১৯৭৯-তে আঠারো বছর সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই সে আর্জেন্টিনাকে পাইয়েছে ফিফা জুনিয়র বিশ্বকাপ। তুমুল গোলযোগের মধ্যেও বার্সেলোনাকে পাইয়ে দিয়েছে কোপা ডেল রে, স্প্যানিশ সুপার কাপ। ১৯৮৩-র এল ক্লাসিকোর সময়ে হেরে গিয়েও যার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে ওভেশন জানায় বার্সেলোনার আর্চ-রাইভাল রিয়েল মাদ্রিদ-এর সমর্থকেরা। যে একাই পারে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতাতে। তাকে দেখতে টিভি চাই। কারণ শুধু ধারাবিবরণী দিয়ে, শুধু বর্ণনা দিয়ে, তাকে বোঝানো যায় না। সেই ভাষা ফুটবলের তখনও তৈরি হয়নি। কারণ তিনি দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।
টিভির দৌলতে সেই ফুটবলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটাও আমূল বদলে গিয়েছিল। কারণ টেলিভশনে চাক্ষুষ না দেখলে বিশ্ব-ফুটবলের আসর অদেখাই থেকে যেত। অদেখা থেকে যেত একটা আস্ত শিল্প। অদেখা থেকে যেত সেই দৌড়— এক বার নয়, দু’বার। ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম। আস্ত একটা দলকে হতভম্ব করে, মাঝপথে ছিটকে দিয়ে, শুধু পায়ের ভাঁজে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গোল করা যে সম্ভব, সেটা এর আগে কেউ করতে পেরেছিলেন কি? এক ফুটবল লেখকের ভাষায়, পেলে কোথা থেকে গোলের দিকে ছুটে আসবেন, ডিফেন্ডার সেটা আগাম আন্দাজ করতে পারতেন না। মারাদোনা কোথা থেকে আসতে পারেন, তার আন্দাজ কঠিন ছিল না। তবু তাঁকে আটকানোর উপায় বার করা যায়নি। টিভির দৌলতে সেই দৌড় চাক্ষুষ করার আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল মেক্সিকো থেকে মধ্যমগ্রাম, পাড়ায় পাড়ায়, ক্লাবে ক্লাবে। আশির দশকের ধূসর দিনগুলো রঙিন হল, সাদাকালো টিভিও আর সাদাকালো রইল না, হয়ে গেল সাদা আর নীল। আর্জেন্টিনার পতাকা উড়ল আরামবাগে।
আর মারাদোনা? প্রথম বার, সরাসরি, রাতের পর রাত জুড়ে বিশ্বকাপ দেখার সময়ে মারাদোনাকে দেখা মানে জীবনে প্রথম নাটকই ওয়েস্ট-এন্ড’এ জন গিয়েলগুড বা রিচার্ড বার্টন দেখার মতো, অথবা জীবনের প্রথম সিনেমাতেই মার্লন ব্রান্ডো, রবার্ট দি নিরো। এর পর আর ঘরে ফেরা যায়? এর পর আর ময়দানে মনোরঞ্জন-সুব্রত দ্বৈরথ চলে? বলা বাহুল্য, চলেনি। এক ধাক্কায় আমরা সবাই এক জনেরই ভক্ত। যারা আর্জেন্টিনার সমর্থক, তারা তো বটেই, যারা চিরবিরোধী ব্রাজিলের সমর্থক, তারাও। সেই উন্মাদনায় কিন্তু ঘাটতি পড়েনি। মেসি, রোনাল্ডোর গত দশকজোড়া আধিপত্য সত্ত্বেও। নাদাল আর ফেডেরার তো গত দু’দশক টেনিসের কান্ডারি। তাতে বিয়ন বর্গ-এর কী আসে যায়?
নাটকের প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯৯০-এর পর মারাদোনার জীবনটাও কিন্তু কম নাটকীয় নয়। আসলে তাঁকে আটকানোর রাস্তা বার করা যায়নি— এটা ঠিক নয়। গিয়েছিল। মেরে, আহত করে, বার্সেলোনায় খেলাকালীন গোড়ালির হাড় ভেঙে দিয়ে। সেই হাড় জোড়া লাগিয়েই তাঁর বিশ্ব ফুটবলে ফেরা। কিন্তু তত দিনে ব্যথা-নিরাময়ের ওষুধের উপর নির্ভরতা তৈরি হয় মারাদোনার। সেটা বাড়তে বাড়তে ১৯৯০-এর পর ক্রমশ কব্জা করে ফেলে তাঁকে। সঙ্গে ড্রাগ, হুজ্জত, ঝগড়াঝাঁটি, ইগোর লড়াই। তার পরের ৩০ বছর মারাদোনার জীবনটা এলোমেলো, এই তিনি ওজন বাড়িয়ে, ঢুলুঢুলু চোখে, ড্রাগে শরীর ভাসিয়ে স্বর্ণকেশী যুবতীর সঙ্গে স্পেনে, তো পরক্ষণেই তিনি কৃশ, উগো চাভেস-এর পাশে দাঁড়িয়ে ‘বুশ ইজ় আ ওয়ার ক্রিমিনাল’ লেখা টি-শার্ট পরে ভেনেজ়ুয়েলায়; এই তাঁর নাপোলি-র মাফিয়া গোষ্ঠীর গোপন আঁতাঁতের খবর, তো পরক্ষণেই কাস্ত্রোর সঙ্গে বন্ধুত্বের আখ্যান।
কোনটা মারাদোনা? সব ক’টাই হয়তো বা। কিন্তু এটাও ঠিক, যতই ট্র্যাজিক হোক মারাদোনার ফুটবল-পরবর্তী জীবন, ফুটবল তাঁকে ভোলেনি, বিশ্বভরা ভক্ত রয়েই গিয়েছে। লিনেকার থেকে পেলে, সবাই মারাদোনার ভক্ত। নাপোলি তার ১০ নম্বর জার্সিকে অবসরে পাঠিয়েছে। আর জনমত সমীক্ষায়, একাধিক বার, পেলে নয়, শতাব্দীর সেরা মারাদোনাই। আর ২০০৮-এ সল্টলেকে সেই জন-উন্মাদনা? খেলা ছেড়ে দেওয়ার দেড় দশক বাদেও? কে ভুলতে পারে এ সব?
কিন্তু সেটাই সব নয়। ইতিহাস সাক্ষী যে ঠান্ডা যুদ্ধের অন্তিমলগ্নে, পেরেস্ত্রোয়িকা-লব্ধ ধ্বংসের মুখোমুখি সোভিয়েট ইউনিয়নের অনেক দূরে দাঁড়িয়ে একার জোরেই দক্ষিণ গোলার্ধের আইকন হয়ে উঠেছিলেন মারাদোনা। নেলসন ম্যান্ডেলা ছাড়া তিনিই একমাত্র গ্লোবাল সেলেব্রিটি যাঁর উত্থান হলিউডের সেলেব্রিটি তৈরির কারখানার বিপরীতে দাঁড়িয়ে, আমেরিকার বিরোধিতায়, দক্ষিণ আমেরিকায় বাম শক্তির পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর মৃত্যুর পর দ্য নেশন পত্রিকা শিরোনাম করেছে ‘কমরেড অব দ্য গ্লোবাল সাউথ’।
ঠিক। কিন্তু গ্লোবাল সাউথ-কে কি উত্তর গোলার্ধে বসে বোঝা সম্ভব? দক্ষিণ গোলার্ধের বিচরণক্ষেত্র তৃতীয় বিশ্বের মাঠে ঘাটে, পাড়ায় পাড়ায়, সাধারণ মানুষের স্বপ্ন দেখার সাহসে, আর্জেন্টিনার বস্তিতে, সাও পাওলোর ফাভেলায় উদীয়মান রোনাল্ডিনহোদের পায়ে পায়ে। আরামবাগে, গড়িয়ায়, শ্যামবাজার মোড়ে।
তাই হয়তো মারাদোনার দৌড়, উদ্দীপনা, বিপক্ষকে হেলায় উড়িয়ে দেওয়া সাহস হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণের সর্বত্র। তাই হয়তো নিয়ো-লিবারাল, ইতিহাস-ঊর্ধ্ব এই বিপুলা পৃথিবীতে ওই হাত ঈশ্বরের নয়; ওই হাত ফকল্যান্ডে ব্রিটিশ অহঙ্কারের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার, ঔপনিবেশিক প্রথম বিশ্বের সামনে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কলোনির, বাজারের চাপে সর্বহারা হওয়া মানুষের প্রতিস্পর্ধী মুষ্টিযোগ।
comments for this post are closed