কেমন ছিলেন ব্যক্তি উত্তমকুমার, মৃত্যুর চার দশক পরে সেটা নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা প্রয়োজনহীন। মানুষ উত্তম মিশুকে; বন্ধু উত্তম আড্ডাবাজ, পুত্র উত্তম মাতৃভক্ত; ইন্ডাস্ট্রির ‘বড়দা’ উত্তম দানশীল; প্রেমিক উত্তম মেদুর; শ্বশুর উত্তম স্নেহশীল; অগ্রজ উত্তম অভিভাবকসম; পেটুক উত্তম ভোজনবিলাসী ইত্যাদি অজস্র আদিখ্যেতা উত্তমকুমারকে নিয়ে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। গত দু’বছর উত্তমকুমারের সিনেমা নিয়ে একটি বইয়ের গবেষণায় বার বারই চোখে পড়েছে এই রকম গদগদ অসংখ্য স্তুতি। সত্যি বলতে, ঘরে ঘরে এ রকম অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা দাদা, সন্তান, শ্বশুর, প্রেমিক হওয়ার বিভিন্ন পরীক্ষায় হয়তো সসম্মান উত্তীর্ণ হবেন। কিন্তু উত্তমকুমার একটাই হয়, একটাই। কাজেই ব্যক্তি উত্তমকুমারকে টেনেটুনে অভিনেতা বা স্টার উত্তমকুমারের সমকক্ষ করার এই যে বার্ষিক প্রকল্প বাঙালি প্রত্যেক বছর তার জন্ম আর মৃত্যুদিনে হাতে নেয়, সেটা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু না।

বরং এতে উত্তমের কিছুটা ক্ষতিই হয়, কারণ ব্যক্তি উত্তম খুবই সাধারণ— মধ্যবিত্ত, ভিতু, অনেকাংশে রক্ষণশীলও বটে। ঝুঁকি না নিতে পারার সহজাত অক্ষমতা ভাল সিনেমা বাছার ক্ষেত্রে তাঁকে ডুবিয়েছেও বেশ কিছু বার— এই নিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রী বা অগ্রগামীর সরোজ দে’র কিছু স্পষ্ট উল্লেখও আছে। এটা বিশেষ করে চোখে পড়ে মধ্য-সত্তরের দশকে, যখন নিজের উপকথাসুলভ জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে উত্তম কিছু ভাল সিনেমা উত্তরকালকে দিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করলেন না। বরং নিজেকে বিলিয়ে দিলেন ইন্ডাস্ট্রিকে ‘বাঁচাতে’। থুড়ি, বিলিয়ে দিলেন না, বলি দিলেন। দয়াশীল উত্তম ইন্ডাস্ট্রির জন্য কল্পতরু হলেন। ফল? ১৯৭৬-১৯৮০-র মধ্যে চল্লিশোর্ধ্ব ছবি, হিন্দিতে কুৎসিত ছবিগুলো-সহ, সবই পাতে দেওয়ার অযোগ্য।

অথচ এ রকম যে হওয়ার কথা ছিল না, সেটা ১৯৫৪-১৯৭৫ সালের মধ্যে উত্তমকে দেখলেই বোঝা যায়, কারণ ব্যক্তি উত্তম সেখানে অনেকাংশেই তারকা বা অভিনেতা উত্তমের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াননি। তার প্রমাণ, বছরে অন্তত দুটো অসাধারণ ছবি। অন্তত, এক বা দুই নয়, কুড়ি বছর ধরে। পৃথিবীর ইতিহাসে যে সমস্ত তাবড় অভিনেতা আছেন, যাঁরা একই সঙ্গে ভীষণ রকম জনপ্রিয় তারকাও বটে, তাঁদের ক্ষেত্রে খুব চেষ্টা করেও দশটা উল্লেখনীয় ছবি পাওয়া যাবে। খুব সহৃদয় হলে পনেরো। সেগুলি সাঙ্ঘাতিক ছবি, সন্দেহ নেই। কিন্তু সংখ্যায় অল্প। সে ক্যারি গ্রান্ট বা হামফ্রে বোগার্ট হোন অথবা মার্লন ব্রান্ডো বা অ্যালেন দিলোঁ। উত্তমের ক্ষেত্রে মনে রাখার মতো ছবি অন্তত পঞ্চাশটা। তার সব ক’টাতেই উত্তম প্রোটাগনিস্ট। এর মধ্যে হাতে গোনা সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ। বাকিটা উত্তম, শুধুই উত্তম।

ওই কুড়ি বছরে বাংলার বা বাঙালির জীবনে একের পর এক বদল এসেছে, ইতিহাসের নিয়মে যেটা স্বাভাবিক। এবং ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই বদলগুলোর সঙ্গে উত্তমের স্টার এবং স্ক্রিন-পার্সোনা বদলেছে। এর কারণ ব্যক্তি উত্তম নয়, অভিনেতা উত্তম। আরও ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে রোম্যান্টিক উত্তম, অভিনেতা উত্তম, আগের মার্কামারা উত্তম, সত্যজিৎ-পরবর্তী ‘বিকশিত’ উত্তম— এই কালানুক্রমিক ধারাবিবরণী উত্তমের ক্ষেত্রে খাটে না। কারণ ‘শাপমোচন’ আর ‘সবার ওপরে’-এর মতো ফর্মুলা মেলোড্রামা ঘেঁষা ছবির ১৯৫৫ সালেই আছে ‘উপহার’ বা ‘হ্রদ’; ১৯৫৭-র ‘হারানো সুর’ বা ‘ইন্দ্রাণী’-র পাশেই ‘বড়দিদি’ বা ‘ডাক্তারবাবু’; এবং উল্লেখ্য ১৯৫৯, যেখানে পাশাপাশি ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ আর ‘বিচারক’। তুলনাহীন ব্যাপ্তি। এবং সেটা চলতেই থাকে। ১৯৬২-তে ‘শিউলিবাড়ি’-র নেহরুভিয়ান ‘মিট্টি’ বাবুর পাশেই ‘কান্না’-র বলিষ্ঠ, কামুক জন; ১৯৬৩-তে ফুরফুরে ‘দেয়া নেয়া’-র পাশেই ‘শেষ অঙ্ক’; ১৯৬৪-র তেজি ‘লালপাথর’-এর পাশেই একাকী ‘জতুগৃহ’। এ রকম অনেক উদাহরণ আছে। অন্তত সত্তরের দশকের শুরু অবধি।

এক কথায়, অভিনেতা আর তারকা উত্তমকে আলাদা করা যায় না। আর ব্যক্তি উত্তম তো অনেকটাই পিছনে। এ কথা বললে অন্যায় হবে না যে যতই সত্যজিৎ রায় দাবি করুন যে স্টার উত্তম অভিনেতা কি না, তা পরখ করতেই ‘নায়ক’-এর সূচনা, আসল কথা হল যে উত্তম অত্যন্ত উঁচু দরের অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ না করে থাকলে মধ্যগগনের সত্যজিৎ এ ঝুঁকি নিতেন না। আর সেটা নিয়ে তিনি যে এতটুকুও ঠকেননি, সে কথা বলতেও উনি কার্পণ্য করেননি। ‘নায়ক’ নিয়ে গল্পকথার অন্ত নেই, যার একটি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। বংশী চন্দ্রগুপ্তর করা ওই ছবির নিখুঁত ট্রেনের সেট দেখে প্রত্যেকের মতো উত্তমও হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন। “কী করে করেন এ রকম সেট, একটু বলবেন বংশীদা?”, উত্তম জানতে চাইলেন। বংশীর উত্তরটা মনে রাখার মতো। উনি বললেন, “উত্তম, তুমি এ রকম আশ্চর্য ন্যাচারাল অভিনয় কী করে করো, যদি বুঝিয়ে দিতে পারো, আমিও তা হলে বোঝাতে পারব সেট-এর রহস্য।” এই দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর হয় না।

ভুল হল। এই প্রশ্নের উত্তর হয়। দু’ভাবে এর উত্তর হয়। উত্তম একা উত্তম হননি, এক দিনে তো নয় বটেই। উত্তম-পূর্ববর্তী বাংলা ছবির মধ্যে বহু কিছু ছিল যা একসঙ্গে, একজোটে, দেশভাগ-উত্তর বাংলা ছবিকে একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড় করায়, স্টুডিয়ো-প্রথা বিলুপ্ত হয়, আর উত্তমের স্টারডম হয়ে ওঠে তার ধারক। কিন্তু কালক্রমে সেই একজোট আর একজোট থাকে না, সেই নান্দনিক আর শৈল্পিক সূক্ষ্মতাতেও ফাটল ধরে। এর অন্যতম বড় কারণ, উত্তমের স্টারডম বাংলা ছবিকে শুধু যশ আর অর্থই দেয়নি, উত্তমের স্টারডম বাংলা ছবির আফিমে পরিণত হয়েছিল। এ এক ভয়ঙ্কর সত্য। তাই সত্তরের দশকে এসে বাংলা ছবির স্থাপত্যে যখন ঘুণ ধরতে শুরু করল, উত্তম হয়ে উঠলেন তার একমাত্র ভরসা। ও দিকে রাজনীতির ছায়া, ব্যক্তিগত জীবনে টানাপড়েন, ইন্ডাস্ট্রির করুণ অবস্থা, হিন্দি ছবির সঙ্গে অসম লড়াইয়ে বার বার বাংলা ছবির পক্ষে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ক্লান্ত, বিরক্ত উত্তম তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে এগিয়ে দিলেন, অভিনেতা উত্তম দাঁড়িয়ে পড়লেন মাঝ রাস্তায়। বুকের জোর আর দাঁড়ানোর জায়গা হারিয়ে আফিমে অভ্যস্ত ইন্ডাস্ট্রি উত্তমের বাইরে দেখতে অস্বীকার করল। এবং ফল হল বিপরীত, যা আগেই বলেছি। উত্তম-পরবর্তী বাংলা ছবির যে করুণ অবস্থা, মনে রাখা দরকার তার শুরু কিন্তু উত্তমের সময়েই। ১৯৮০-র জুলাই তাতে অনিবার্যতার ফলক লাগিয়েছিল মাত্র।

দ্বিতীয় কারণটা এর পরিপূরক। যতই বাংলা ছবি উত্তম নামক নেশায় আবিষ্ট হোক, যতই স্টার-টেক্সটের উন্নত পাঠ্যক্রম হোন উত্তম, এ কথা অনস্বীকার্য যে উত্তমের স্টারডম ছিল বাংলা ছবির সীমিত পরিসরের তুলনায় অনেকটাই ব্যাপ্ত। যেটাকে বলা যায় উত্তমের স্টারডমের সারপ্লাস ভ্যালু। তাই বার বার বাংলা ছবি চেষ্টা করেছে উত্তমকে তার পরিসরে আটকে রাখার, আর বার বার উত্তম সেটা ভেঙে বেরিয়ে তৈরি করেছেন স্টারডম আর অভিনয়ের এক অননুকরণীয় যুগলবন্দি। এই সারপ্লাস ভ্যালুই কিন্তু বলে দেয়, কেন তাঁর মৃত্যু বাংলা ছবিকে শুধু দরিদ্র করে দেয় না, নিঃস্ব করে দেয়। প্রায় সাড়ে তিন দশকের প্রাপ্তি এক ঝটকায় বিদায় করে দেওয়া হল ১৯৮০-তে এসে, কারণ উত্তমহীন বাংলা ছবি আর বাংলা ছবি রইল না, খেই হারিয়ে ফেলল।

‘নায়ক’ ছবিতে এই স্টারডমের অমোঘ সত্তা প্রকট। আর প্রকট ‘চিড়িয়াখানা’র পোস্টারে, যেখানে সাসপেন্স-ধর্মী ছবিতে সত্যজিৎ ঘটালেন এক স্বভাববিরুদ্ধ ব্যতিক্রম— ‘ব্যোমকেশ’-এর জায়গায় ধূসর অক্ষরে লিখলেন ‘উত্তম’। চরিত্রের থেকেও অভিনেতার স্বাক্ষর সত্যজিতের আর কোনও ছবির পোস্টার বহন করে কি? না।

কারণ? ওই সারপ্লাস। আর ওই সারপ্লাসই কারণ মৃত্যুর চল্লিশ বছর পরে উত্তমকুমারের জীবিত থাকার; ওই সারপ্লাসই পারে সেলুলয়েড-উত্তর পৃথিবীতে বসে সেলুলয়েডের আকর্ষণ প্রত্যক্ষ করতে; এই সারপ্লাসই কারণ হতে পারে যে এক দিন উত্তমের সব ছবি তামাদি হয়ে যাবে, শুধু উত্তম ছাড়া।

এ এক আশ্চর্য স্টারডম। মর্মান্তিক স্টারডম।